চুয়াডাঙ্গা জেলা
চুয়াডাঙ্গা জেলা বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ জনপদ। এটি বৃহত্তর খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বাংলাদেশের অতি ছোট জেলাগুলোর মধ্য চুয়াডাঙ্গা একটি। এর আয়তন মাত্র ১১৭৪.১০ কিলোমিটার। জেলায় তেমন দর্শনীয় স্থান না থাকায় পরিচিতির দিক দিয়ে রয়েছে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরল ভূমিকা পালন করে চুয়াডাঙ্গা। গৌরবময় ইতিহাস গর্বিত করে জেলাবাসীদের। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম কমান্ড; দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড গঠিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়।
মুক্তিযুদ্ধের আট নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিলো চুয়াডাঙ্গা সদরের ৪নং ইপিআর এর হেডকোয়ার্টার। ৪নং ইপিআর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এবং ডাঃ আসহাব-উল-হক জোয়াদ্দার একই দিন একই সময়ে সকাল ৯ টা ৩০ এ চুয়াডাঙ্গা শহরের বড়বাজার চৌরাস্তার মোড়ে সর্বপ্রথম দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে ১০ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চুয়াডাঙ্গাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬ই এপ্রিল তা কার্যকরের কথা থাকলেও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পরে তা মেহেরপুরের মুজিবনগরে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুজিবনগরকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী করা হয়।
এখানেই চুয়াডাঙ্গার ইতিহাসের ইতি নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক বিভাগ এবং টেলিযোগাযোগের ব্যবস্থা সর্বপ্রথম এই চুয়াডাঙ্গাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্যান্য স্থানসমূহ
১৮৬২ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে রেললাইন ও রেল চলাচল শুরু করেন। সর্বপ্রথম চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতী পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়।
তাছাড়া চুয়াডাঙ্গার দর্শনা (বর্তমান দর্শনা হল্ট) রেলওয়ে ষ্টেশন বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে ষ্টেশন। জেলাটিতে রয়েছে নানা যুগের ১০৪টি প্রাচীন নিদর্শন।
প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে-দর্শনা ডিস্টিলারী হাউজ, কেরু অ্যান্ড কোং বাংলাদেশ লিঃ, হিরোম-লের পুকুর ও বাগানবাড়ি, পুরাতন হাউলি দোয়া, ম-লবাড়ি বাস্তুপুর, কার্পাসডাঙ্গা নীলকুঠি, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘর ও নদীর ঘাট , নাটুদা গণ আটকবর, গচিয়াপাড়া হাজার দুয়ারী স্কুল, নাটুদা জোড়া শিবমন্দির, দেশের সর্বপ্রথম রেলওয়ে ষ্টেশন দর্শনা হল্ট স্টেশন, কার্পাসডাঙ্গা মিশন, চুয়াডাঙ্গা ডিসি ইকোপার্ক, শিবনগর জামে মসজিদ, গোলাম মোস্তফা (ঘটু মোল্লা) বাড়ি, রাম বাবুর বাড়ি, রেজা চিশতি (র.) মাজার, মধু জমিদারের পুকুর (জলাধার), জুড়ানপুর মমালিতা ভবন, ভালাইপুর নীলকুঠি, লোকনাথপুর নীলকুঠি, হোসেন মঞ্জিল, কার্পাসডাঙ্গা প্রাচীন গির্জা, খ্রিস্টান পাদ্রীর কবর, কার্পাসডাঙ্গা নীলকুঠির প্রবেশ তোরণ, কুঁকিয়া চাঁদপুর নীলকুঠি (বিলুপ্তপ্রায়), হযরত কিতাব আলী শাহ মাজার, কমলার দোয়া, বাংলাদেশের প্রথম ও চুয়াডাঙ্গার প্রধান ডাকঘর, জীবননগর সেন মন্দির, ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুড়ুলগাছি পীরগঞ্জ জামে মসজিদ, মোমিনপুর বোয়ালমারী পুরাতন জামে মসজিদ, বোয়ালমারী জমিদার বাড়ি, ভিমরুল্লাহ পুরাতন জামে মসজিদ, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের মামার বাড়ি জীবননগর কাশীপুর জমিদার বাড়ি, সাগরমনী দেবীর বাড়ি, হীরালাল দত্তের বাড়ি, তিতুদহ মিয়াপাড়া জামে মসজিদ, সিরাজ মঞ্জিল, জেলা আইনজীবী সমিতি ভবন, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, শহীদ-উর-রহমানের বাড়ি, সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জীবননগর সপ্তম অ্যাডওয়ার্ডের পাতকুয়া, বটকৃষ্ণ ইন্দ্র কুমারের বাড়ি, প্রাচীন লোহারপুল, খন্দকার বাশার মোল্লার বাড়ির ঢিবি, আলমডাঙ্গা দোবে জমিদারদের কাচারী ও তহশিলখানা সনাতনপুর, জমিদার বিজয় কুমার দোবের বাড়ি, দোবে জমিদার বাড়ির মন্দির, ঘোলদাড়ি নীলকুঠি, কামিনী ফকিরানীর বাস্তুভিটা, জামজামি শাহী জামে মসজিদ (বিলুপ্ত), কাজী গোলাম দরবেশের কাচারী বাড়ি (মসজিদ সংলগ্ন), জামজামি ঈদগা ধ্বংসাবশেষ, ঘোষবিলা (ধুলিয়া) নীলকুঠি, মতিলাল আগারওয়াল বাড়ি, আলমডাঙ্গা কুমারী সাহা জমিদার বাড়ি, সাহা জমিদার বাড়ির প্রাচীন পাতকুয়া, কুমারী কালী মন্দির, আলমডাঙ্গার লালব্রিজ বা লালসেতু , আলমডাঙ্গা দোতালা রেলস্টেশন, হযরত বিনোদিয়া (র.) মাজার, শ্রী শ্রী সত্য নারায়ণ মন্দির, চুয়াডাঙ্গা পৌর বড় মসজিদ, ধোপাখালী পুরাতন মসজিদ, জীবননগর পেয়ারাতলা রাখাল শাহ মাজার, চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন, সুভাষিনী দাসের বাড়ি, মতিরাম আগরওয়ালার বাড়ি, দামুড়হুদা বেগুপাড়া মসজিদ, কার্পাসডাঙ্গার কুতুবপুর মসজিদ, হযরত মেহমান শাহ মাজার ও তৎসংলগ্ন ঢিবি, পীর বুড়া দেওয়ানের দরগাহ, জীবননগর আন্দুলবাড়িয়া অজ্ঞাত ইমারত, হযরত মানিক পীরের মাজার, খাজা পারেশ সাহেবের মাজার, চুয়াডাঙ্গা সদর বড়সলুয়া মহিশতলা মসজিদ ঢিবি, কালুপোল রাজার ভিটা, গড়াইটুপি হযরত মল্লিক শাহ মাজার, মুজিবনগর বাগোয়ান শেখ ফরিদের মাজার, বাগোয়ান শাহী জামে মসজিদ, আলমডাঙ্গা ঘোষবিলা হযরত শাহনূর (বাঘী দেওয়ান) আলমডাঙ্গার বধ্যভূমি, বাগদাদী (র.) এর মাজার, ঘোষবিলা প্রাচীন মসজিদ ইত্যাদি।
যুদ্ধকালীন গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে, দামুড়হুদার নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে তিনটি গণকবর, হৈবতপুরে, জীবননগরে সীমান্তবর্তী ধোপাখালী গ্রামে এবং আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ ক্যানালের তীরবর্তী স্থানে যুদ্ধের স্মৃতিধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিস্তম্ভ। জেলায় রয়েছে- নবগঙ্গা নদী, চিত্রা নদী, ভৈরব নদ, কুমার নদ, মাথাভাঙ্গা নদী। যদিও কালের আবর্তে সবগুলো নদী আজ মৃত প্রায়। মাথাভাঙ্গা নদীই এখন জেলার পরিচয় নদী, সেটাও ধ্বংসের দিকে। দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আরো আছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রথম কৃষি খামার জীবননগরের দত্তনগর কৃষিখামার।
এছাড়াও দামুড়হুদার নাটুদহের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর, যা আট কবর নামে পরিচিত। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ দর্শনা কেরুজ চিনিকল, হাজারদুয়ারি স্কুল, কার্পাসডাঙ্গার নীলকুঠি, আলমডাঙ্গার ঘোলদাড়ি ওমর শাহর মসজিদ, তিয়রবিলা বাদশাহী মসজিদ, চুয়াডাঙ্গা সদরের গড়াইটুপিতে সাধক হযরত খাজা মালিক গাউস (র.) মাজার, চারুলিয়ার মেহমান শাহরের মাজার, জমিদার নফর পালের প্রাকৃতিক শোভাবর্ধনকারী তালসারি সড়কসহ বিভিন্ন স্থান।
অসংখ্য প্রাচীন ও নতুন নিদর্শন এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট জেলা চুয়াডাঙ্গা। জেলাবাসীদের চাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের এই জেলা বাংলাদেশের মানচিত্রের অন্যতম একটি জেলা হয়ে থাকবে। জেলা পাবে তার পূর্ণ মর্যাদা। ঘোষণা করা হবে একটি ঐতিহাসিক জেলা রুপে।
0 coment rios: